Skip to main content

পৌনে তেরোর নামতা

“এতক্ষণ ধরে বোকার মত বসে ছিলি কেন? ঢেউ গুনতে পারিস নি? প্রতি ঢেঊয়ে সাত পয়সা করে হলে এতক্ষণে তুই লাখপতি হয়ে যেতিস, জানিস?”
আমি বললুম, বোকার মত বসে থাকিনি তো। আমি তো ইলিশ মাছের নৌকো গুনছিলাম।

ছোটোকাকা ছেড়ে দেবার লোক নন। বলল, সেটা অবশ্য ঠিকই করছিলি। তা কী করে বুঝলি কোন্‌ জেলেডিঙ্গি ইলিশের আর কোন্‌টা চিংড়ির?

ওই যে, যে নৌকোর মেছোরা মাথায় গামছা পেঁচিয়েছিল সেগুলো ইলিশের, আমি জানি। জালে বাধা পেয়ে ইলিশেরা যখন উড়ুক্কু মাছের মত সাঁই সাঁই করে লাফিয়ে নৌকোয় ওঠে তখন ওদের ধারালো পেটির ঘায়ে মেছোদের মাথা কেটে যায় কিনা, তাই গামছা পেঁচিয়ে রাখে। আমি দেখেছি।

ছোটোকাকা বলল, তা যখন এতোই জানিস, তাহলে মুখটা সবসময় অমন সাড়ে পাঁচের মত করে রাখিস কেন? পৌনে পনেরোর নামতা জানিস?

আমি ম্লান হয়ে বললাম, পৌনে পনেরো কেন ছোটকা? পনেরো কি উনিশ বলো, আমি ঠিক পারব।

ছোটোকাকা আমার কানে একটা প্যাঁচ দিয়ে বলল, না ঐ পৌনে পনেরোর ঘরের নামতাই বলতে হবে। আমি অখন অতিকষ্টে পৌনে পনেরো দুগুনে, ইয়ে মানে সাড়ে উনত্রিশ, পৌনে পনেরোত্তিনে (আবার ঢোঁক গিলে) সওয়া চুয়াল্লিশ এই করতে করতে যখন পৌনে পনেরোদ্দশে একশ সাড়ে সাতচল্লিশে থেমেছি, ছোটকাকা কিছু না বলে আমার নড়া ধরে টানতে টানতে বাবার কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, দাদা, বুকুন এখন সাত বছরেরটি হয়েছে। আপনি মত করুন ওকে কলকাতায় নিয়ে যাই। আমার বাসাবাড়িতে থাকবে, ইশকুলে পড়বে।

বাবা বলল, তুই আর হাসাস নি ফণী। তুই পড়িস ডাক্তারি। সময় কোথায় পাবি বুকুনকে দেখার? এমনিতেই বয়ে যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে আরও –। তা ছাড়া, ও যা ভ্যাব্‌লা প্রকৃতির ছেলে, কলকাতায় গিয়ে রাস্তায় ট্রামের তলায় গিয়ে মরবে।

ছোটকা গলা খাটো করে কী যেন বলল। বাবা একসময় রাজি হয়ে গেল। মা আঁচলে চোখ মুছল।

কিষাণগঞ্জ থেকে কলকাতা, নৌকো তারপর স্টীমার তারপর ট্রেন। শিয়ালদায় নেমে ট্যাক্সি।

*****

বাগবাজারের ঘাটে নৌকো চুক্তি করছে একজন ফড়ে মতন লোক। সঙ্গে এক আড়তদার। বাঘের মত চেহারা।

- মনকরা কতোয় দিবি রে ?
নৌকো ভিড়তে না ভিড়তে দরদস্তুর শুরু হয়ে যায়, খুচরো ক্রেতারা ধারেই ঘেঁষতে পায় না।

জেলে বলছে, মনপিছু দেড়শোর কমে হবেনিকো।

ফড়ে আর আড়তদারে চোখাচুখি করে জেলেকে বলল, দেড় শো? তাহলে বল দি’নি একটা আড়াই সেরি ইলিশের দর পাইকিরিতে কতো পড়ছে?

আমি বাগবাজারের ঘাটে মাঝে মাঝেই গিয়ে চুপ্‌টি করে বসি। আমার মুখে নিশ্‌পিশ করতে লাগল উত্তরটা।

চট করে বলে দিলুম, নয় টাকা ছ আনা।

দুজনেই আমার দিকে প্রশ্নসুচক চোখে তাকালো।

আমি বিস্তারিত করে বললাম, শুভঙ্করী আর্যা আমার জানা আছে কিনা। মণ প্রতি যত টঙ্কা হইবেক দর/ আড়াই সেরেতে তত আনা করে ধর। তা দেড়শো আনা কে ষোলো দিয়ে ভাগ করলে ঐ নয় টাকা ছ আনাই দাঁড়ায় তো।

আড়তদার বললেন, বাপা, তোমার কথায় বার্তায় মনে হচ্ছে তুমি গ্রাম দেশের ছেলে। পড়াশুনা কিছু করো?

অপরিচিত লোকেদের আজ্ঞে করে বলতে হয়। অবশ্য ধুতি খাটো হলে আজ্ঞেমাজ্ঞে না করলেও চলে। ইনি খাটো ধুতি, পকেটওয়ালা হাফ শার্ট। তেল চুপ্‌চুপে মাথা, মাঝে সিঁথি, ঝোলা গোঁপ। আমার এদিককার ঘটি ভাষা তো বেশ রপ্ত-ই। তবু এই আড়তদার বাবু ধরে ফেলল আমি গাঁ-ঘরের ছেলে। 'নয় টাকা' বলে ফেলছি ন’টাকার বদলে, সে তো আর শোধরাবার উপায় নেই।

এত দুঃখ হচ্ছিল। তাই আরও কষে খাঁটি কলকাতার জবানে উত্তর দিলাম। বললাম, আজ্ঞে, আমি কলকেতায় লতুন এয়েচি। ইস্কুলে যাই বৈকি। সামনের বারে বৃত্তি পরীক্ষে দোবো।

- কোন ইস্কুল?
- কাশী মিত্র প্রাইমারি।
- থাকো কোথায়?
- আজ্ঞে, ছকু খানসামার গলিতে। কাকা আছেন, কারমাইকেলে ডাক্তারি পড়েন। তাঁর কাছে আছি।
তা যাও বাপু, তোমাদের ইস্কুলের হেডমাস্টার বর্ধন মশাইকে আমার নাম করে বোলো, তোমার পড়তে পয়সা লাগবে নাকো। খাতা বইপত্তরও মাগনা পাবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আজ্ঞে আপনার নামটা?

গুঁপো আড়তদার বাবুটি কিছু বলবার আগেই আর এক ফড়ে বলে উঠল, বলচ কী হে ছোকরা, এঁকে জানো নি? ইনি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, স্যার আশুতোষ মুকুজ্জে।


তা ভাইসও বুঝলুম না, চ্যান্সেলরও মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। তাও মুকুজ্জে শুনে পা ছুঁয়ে পেন্নাম করে ফেললুম। ইনি মাছের আড়তদার মানুষ নন তবে।

আমি ফ্রীতে পড়তে পাবো সেটা বোঝা গেল।

লাফাতে লাফাতে ছোটোকাকার বাসার দিকে রওনা দিতে আশুবাবু পেছন থেকে হেঁকে বললেন, তোমার নামটি তো জানা হল না ছোকরা !

আমি বলুম, আজ্ঞে, আমার নাম কেশব। কেশবচন্দ্র নাগ।


উনি বললেন, অঙ্কটা ছেড়ো না বাপু।

♥️♥️♥️♥️♥️♥️🙏🙏

Comments

Popular posts from this blog

আরুণির গুরুভক্তি

প্রাচীন ভারতে শিক্ষার্থীদের গুরুগৃহে গিয়ে থেকে শিক্ষা গ্রহনের একটা রীতি ছিল। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং নৈতিক মূল্যবোধের পাঠ পড়ানোর জন্য বৈদিক ঋষিরা আশ্রম প্রথার প্রচলন করেছিলেন। আশ্রমপ্রথা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি বর্ণাশ্রম, অন্যটি চতুরাশ্রম। কর্মের ভিত্তিতে সমাজে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র এই চার শ্রেনীর লোক বাস করত। মানুষের জীবনকালকে ভাগ করা হত ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্নাস এই চারটি শ্রেনীতে। ব্রহ্মচর্য পালনের সময় শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহে যেত। পুঁথিগত বিদ্যা ও নৈতিক মূল্যবোধের পাঠ শেষ করে  নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসে গার্হস্থ জীবনে প্রবেশ করত। শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহকে নিজের বাড়ির মতোই মনে করত। গুরুও শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিতেন। আজকের গল্পটা মহান ঋষি বেদব্যাস রচিত মহাভারত গ্রন্থ থেকে গৃহীত। আজকের গল্প আরুনির উপাখ্যান বা আরুনির উদ্দালক হয়ে ওঠার কাহিনী।  পুরাকালে ভারতে অয়োদ ধৌম্য নামে এক ঋষি ছিলেন। তাঁর আশ্রমে ব্রহ্মচর্য পালনের জন্য শিক্ষার্থীরা আসত। আরুণি, উপমণ্যু এবং বেদ নামে তাঁর তিন শিষ্য ছিল। তখন বর্ষাকাল। জলের তোড়...

দশানন রাবণকৃত শ্রী শিবতান্ডব স্তোত্রম

দশানন রাবণকৃত শ্রী শিবতান্ডব স্তোত্রম বাংলা অনুবাদ সহ (১) জটাটবীগলজ্জল প্রবাহ পাবিতস্থলে গলেহবলম্ব‍্য লম্বিতাং ভূজঙ্গতুঙ্গমালিকাম । ডমড্ডমড্ডমড্ডমন্নিনাদবড্ডমর্বয়ং চকার চন্ডতান্ডবং তনোতু নঃ শিবঃ শিবম।।।।। । (২) জটাকটাহ সম্ভ্রম ভ্রমন্নিলিম্পনির্ঝরী বিলোল বীচিবল্লরী বীরাজমানমূদ্ধনি।। ধগদ্ধগদ্ধগজ্জলল্ললাট পট্রপাবকে কিশোরচন্দ্রশেখরেরতিঃ প্রতিক্ষণং মম।। (৩) ধরাধরেন্দ্রনন্দিনীবিলাসবন্ধুবন্ধুর স্ফুরদ্দিগন্ত সন্ততি প্রমোদ মানমানসে কৃপাকটাক্ষ ধোরণীনিরুদ্ধদুর্ধরাপদি ক্বচিদ্দিগম্বরেমনো বিনোদমেতুবস্তুনি।।।। (৪) জটাভুজঙ্গ পিঙ্গল স্ফুরৎফণামণিপপ্রভা কদম্বকঙ্কুমদ্রবপ্রলিপ্তদিগ্বধূমুখে।। মদান্ধসিন্ধুরস্ফুরত্ত্বগুত্তরীয়মেদুরে মনো বিনোদ মদ্ভূতং বিভর্তু ভূতভর্তরি।। (৫) সহস্রলোচনপ্রভৃত‍্যশেষলেখশেখর প্রসূনধূলিধোরণীবিধূসরাঙঘ্রিপীঠভূঃ। ভুজঙ্গরাজমালয়া নিবদ্ধজাটজূটকঃ শ্রিয়ৈ চিবায় জায়তাং চকোর বন্ধুশেখর।।।। (৬) ললাটচত্বরজ্বলদ্ধনঞ্জয়স্ফুলিঙ্গভা নিপীতপঞ্চসায়কং নমন্নিলিম্পনায়কম। সুদাময়ূখলেখয়াবিরাজমানশেখরং মহাকপালি সম্পদে শিরো জটালমস্তু নঃ।।।।। (৭) করালভাল পট্টিকাধগদ্ধগদ্ধগজ্জল দ্ধনঞ্জয়াহুতীকৃতপ্রচন্ড পঞ্...

বিষ্ণুর দশাবতার

বিষ্ণুর দশ অবতার এর নাম হল --- মৎস্য কূর্ম বরাহ নৃসিংহ বামন পরশুরাম রাম কৃষ্ণ বুদ্ধ কল্কি 1. মৎস্য অবতার মৎস্য ভগবান বিষ্ণুর প্রথম অবতার রূপ। এই অবতার রূপে সত্যযুগে বিষ্ণুর আবির্ভাব। পুরাণ অনুযায়ী পৃথিবীর প্রথম মানুষ মনুকে এক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে মৎস্য রূপে বিষ্ণু আবির্ভূত হন। শরীরের উপরের অংশ পুরুষ মানুষের মত কিন্তু নীচের অংশ মাছের মত। 2. কূর্ম অবতার কূর্ম ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার। সত্যযুগে এই অবতার রূপে বিষ্ণু আবির্ভূত হন। পুরাণে বলা হয় সমুদ্রমন্থনের সময়, মন্থন কালে মন্দর পর্বত সমুদ্রের নীচে ডুকে যাচ্ছিল। তাই সেই সময় বিষ্ণু কূর্ম অবতার অর্থাৎ কচ্চপের রূপে আবির্ভূত হয়ে পর্বত তাঁর পৃষ্ঠে ধারণ করেন। যার ফলে অমৃত প্রাপ্তি সম্পূর্ণ হয়। 3. বরাহ অবতার বন্য শূকরের রূপ ধারণ করেছিলেন ভগবান বিষ্ণু। এটি তাঁর তৃতীয় অবতার। বরাহ অবতারে তিনি সত্য যুগে আবির্ভূত হন। পুরাণ মতে পৃথিবীকে হিরণ্যাক্ষ নামক মহাশক্তিশালী অসুরের হাত থেকে রক্ষা করতে এই অবতার রূপে বিষ্ণু আসেন। অসুর পৃথিবীকে মহাজাগতিক সমুদ্রের নীচে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বরাহ রুপী বিষ্ণু হিরণ্যাক্ষের সাথে ক্রমাগত হাজার বছর যুদ্ধ করে তাকে প...