#হারানো_ইতিহাসের_খোঁজে
• পুরোটা পড়ার অনুরোধ থাকলো । লেখার ভুল ত্রুটি মার্জনীয় ।
• অস্তাচলগামী এক রাজপ্রাসাদের কাহিনী •
মুর্শিদাবাদ বলতেই প্রথমেই যেই ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হলো ১৮২৪ সালে নবাব নাজিম হুমায়ূন ঝাঁ- এর তত্ত্বাবধানে ভাগীরথী নদী তীরে গড়ে ওঠা হাজারটি দুয়ার সমন্বিত একটি হলুদ রঙের প্রাসাদ , যা ইতিহাসে হাজারদুয়ারী প্যালেস মিউজিয়াম নামে পরিচিত । এছাড়া মুর্শিদাবাদ বললেই মনে আসে নানা ঐতিহাসিক গল্প কাহিনী , নানা স্থাপত্য কীর্তি আর সর্বপরি পলাশীর যুদ্ধের গোপন ষড়যন্ত্রের গল্প এবং ভারতে ব্রিটিশ রাজের সূচনাকাল ।
এই ইতিহাসের সবই তৎকালীন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ শহরকে ঘিরেই । কিন্তু এই ইতিহাসেরই অন্তরালে টুপ করে ডুবে গেছে আরও একটি শহরের ইতিহাস । এই শহরের নাম হলো কাশিমবাজার । ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ শহরের প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এই শহর । যদিও তৎকালীন সময়ে এর নাম ছিলো মাসুমাবাজার । এই মাসুমা কথার ইংরেজী প্রতিশব্দ Chaste Lady অর্থাৎ সতী নারী । কাজেই এই স্থান সতী বাজার বলে পরিচিত ছিলো । পরবর্তীতে রণ নিপুণ যোদ্ধা কাশিম খান হুগলি দূর্গ থেকে এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন , তারপর থেকেই তাঁর নামানুসারে এই মাসুমাবাজার অঞ্চলের নাম হয় কাশিমবাজার । মতপার্থক্যে এই অঞ্চলে কাশিম নামের একজন পীর ছিলেন যাঁকে মৃত্যুর পর পুরনো ইংরেজ কবরখানার নিকটবর্তী হাতিবাগানে সমাধিস্থ করা হয় এবং সেই পীরের নাম থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় কাশিমবাজার ।
পদ্মা , ভাগীরথী ও জলঙ্গী নদীর পার্শ্ববর্তী কাশিমবাজার 1661 খ্রিস্টাব্দে একটি বিশেষ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে । এখান থেকে রেশম , কাঁসা, নীল, হাতির দাঁতের তৈরী জিনিস , দেশী ঘি, কর্পূর , মশলাপাতি ইত্যাদি বাইরে রপ্তানি করা হতো । কাশিমবাজারের কাছেই কালিকাপুর অঞ্চলে ওলন্দাজ বাণিজ্যিক কুঠি গড়ে উঠেছিলো ।
এসব তো গেলো কাশিমবাজারের ইতিহাস । এবারে কাশিমবাজারের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই জরাজীর্ণ রাজবাড়ির গায়ের গভীর ফাটলগুলির প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসকে জেনে নেওয়া যাক ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এখানকার বিখ্যাত নন্দী বংশের সন্তান কৃষ্ণকান্ত নন্দী এই রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন । এই রাজবাড়ি শ্রীপুর প্রাসাদ নামে পরিচিত ছিলো। এই কৃষ্ণকান্ত নন্দী ছিলেন কাশিমবাজারের এই রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা । তাঁদের বংশানুক্রমিক একটি মুদির ব্যবসা ছিলো তাই তিনি সকলের কাছে কান্তমুদি নামে পরিচিত ছিলেন । কৃষ্ণকান্ত নন্দীর পিতা রাধাকৃষ্ণ নন্দীর সময় থেকেই এই মুদির দোকান থেকে ইংরেজ কুঠিতে মাল সরবরাহ করা হতো । এছাড়া তাঁর একটি রেশমের ব্যবসাও ছিলো । তিনি রেশম এবং সুতির সুতোর সংমিশ্রণে এমন একটি সুতোর প্রচলন করেন যা দিয়ে তৈরী কাপড় বেশ টেকসই হতো । এই ব্যবসা করে রাধাকৃষ্ণ নন্দী মহাশয়ের সাহেব মহলে বেশ নামডাক হয় । পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জেষ্ঠ্য পুত্র কৃষ্ণকান্ত নন্দী এই ব্যবসার হাল ধরেন । সেই সূত্রে ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেবের সঙ্গে কৃষ্ণকান্তের বেশ পরিচয় ছিলো । 1756 সালে নবাবের সিংহাসনে বসার পর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লা কাশিমবাজার ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করেন । এমন অবস্থায় হেস্টিংস যখন ভাবছেন যে আত্মরক্ষার্থে কার কাছে যাওয়া যায়, তখনই কাশিমবাজারের কান্তমুদির কথা তাঁর স্মরণে আসে । রাতের অন্ধকারে গোপনে হেস্টিংস সাহেব কান্তবাবুর কাছে গিয়ে হাজির হোন। প্রথমে কয়েকদিন নিজের দোকানেই সাহেবকে লুকিয়ে রাখেন কৃষ্ণকান্ত নন্দী , পরে অত্যন্ত সন্তর্পণে নিজের বাড়িতে সাহেবকে নিয়ে যান কান্তবাবু । হাতের কাছে কিছু না পেয়ে কেবল পান্তাভাত এবং চিংড়ি মাছ দিয়েই হেস্টিংসকে আপ্যায়ন করেন তিনি । পরবর্তীতে হেস্টিংস সাহেবকে গোপনে কাশিমবাজার থেকে পালিয়ে যেতেও সাহায্য করেন কান্তবাবু । এভাবে খুব সহজেই সাহেবের মন জয় করে ফেলেছিলেন কান্তমুদি এবং হয়ে উঠেছিলেন তাঁর প্রিয়পাত্র । পরবর্তীতে পলাশীর যুদ্ধের পর ওয়ারেন হেস্টিংস যখন বাংলার গভর্নর হলে , কান্তবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন স্বরূপ তাঁর পালিত পুত্র লোকনাথ রায়কে দিল্লীর বাদশার কাছে মহারাজা করার সুপারিশ করেন । অতঃপর তাঁর নাম হয় লোকনাথ রায় বাহাদুর । এছাড়াও ওয়ারেন হেস্টিংস যখন কাশীর রাজা চেত সিংয়ের রাজ্য আক্রমণ করেন তখন তিনি কৃষ্ণচন্দ্র নন্দীকে তাঁর সঙ্গে নিয়েছিলেন । নন্দী মহাশয়ও সেখানে গিয়ে বেশ প্রতাপের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং চেত সিংকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন । কান্তবাবু কাশী থেকে অনেক মণিমুক্তা, অলঙ্কার, মোহর ইত্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন । এছাড়া নিয়ে আসেন সূক্ষ্ম কারুকাজ করা লাল পাথর দিয়ে নির্মিত ১০০ টি সুদৃশ্য থাম , যা তিনি তাঁর শ্রীপুর প্রাসাদের শ্রী বৃদ্ধির জন্য প্রাসাদের অন্দরে লাগিয়েছিলেন । ১৮৪৪ সালে কৃষ্ণকান্ত নন্দী মারা যান।
তাঁর নিজের কোনো পুত্র না থাকায় এই বিশাল জমিদারির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তাঁর স্ত্রী রাণী স্বর্ণময়ী দেবী । তিনিই রাজবাড়ির অন্দরে লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির স্থাপন করিয়েছিলেন ।
স্বর্ণময়ী দেবীর মৃত্যুর পর কান্তবাবুর ভাগ্নে মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী কাশিমবাজারের জমিদারি দেখার গুরুভার গ্রহণ করেন । ইতিহাসে তিনি দাতাকর্ণ নামে পরিচিত ছিলেন । তিনিই এই কাশিমবাজার বড়ো রাজবাড়ির সিংহ দুয়ারের সামনের লম্বা পিলার যুক্ত অংশটি তৈরী করিয়েছিলেন । ইনার সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের এই কাশিমবাজার রাজবাড়িতে। ১৯০৭ সালে এই রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় সুবে বাংলার প্রথম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বেই এই প্রাদেশিক সম্মেলনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের সাহিত্যসেবী রাজা-রাজড়া ও প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকরা উপস্থিত হয়েছিলেন। নিজের কণ্ঠেই স্বরচিত গান গেয়ে অতিথিদের আপ্লুত করেছিলেন কবি।
কাশিমবাজার রাজপ্রসাদের আটটি বাড়িতে আগত অতিথিদের থাকার জন্য সুবন্দোবস্ত করা হয়। মধ্যাহ্নভোজে ৬৪ রকমের পদের খাবারের ব্যবস্থা ছিল।
মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর দানের দৌলতে একদা কাশিমবাজার ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। মণীন্দ্রচন্দ্র ও মনীষী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ট্রেনে চেপে কাশিমবাজার রাজবাড়িতে পৌঁছেছিলেন। রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবি ঠাকুর। সাহিত্য সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে উঠে সে কথা স্বীকার করেও নেন ।
১৯২৯ সালে মনীন্দ্র নন্দী ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ে প্রাণ হারান । এরপর তাঁর পুত্র শ্রীশচন্দ্র নন্দী রাজা হোন এবং তিনিই ছিলেন এই বিরাট জমিদার পরিবারের সর্বশেষ রাজা ।
এখন এই রাজবাড়িটি পুরো খাঁ খাঁ করে । এখন আর না থাকেন কোনো রাজা, না আছেন রাণীমহল আলো করে থাকা কোনো রাণী । দাস দাসীদেরও যেনো চিরতরে ছুটি হয়ে গেছে । রাজসভায় নেই কোনো মন্ত্রী সভাসদগণ । প্রবেশদ্বারের সামনে আর দেখা যায় না কোনো বল্লম বর্মধারী সেপাই , কিংবা কোনো পাইক বরকন্দাজ । প্রজারাও এসে আর ভিড় করেন না রাজ দরবারে । ঘোড়াশালে নেই কোনো ঘোড়া , হাতিশাল আজ হাতি শূন্য । অন্দরের মন্দির থেকে আর ভেসে আসে না কোনো শঙ্খ কাঁসর ঘণ্টার শব্দ কিংবা কোনো উলুধ্বনি , ফাঁকা ঠাকুরদালানে আর হয় না দুর্গাপুজো । কেবল অতীত স্মৃতি আর কালের গভীর স্রোতে মৃতপ্রায় ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে এককালের সেই জৌলুসময় বিশাল অট্টালিকা । সময়ের করাল গ্রাসে বহুদিন আগেই শ্রীপুর প্রাসাদ হারিয়েছে তার পুরনো শ্রী । কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত সেই কাশিমবাজার রাজবাড়ি এখন অবহেলায় জীর্ণ একটি প্রাসাদ । আজ তার দেওয়াল ফুঁড়ে বেরিয়েছে বট, পাকুড়ের শেকড় । প্রাসাদের সামনের জমি বিক্রয় হয়ে গেছে, সামনে তৈরী হয়েছে বসতবাড়ি । চারিপাশে গজিয়ে উঠেছে অসংলগ্ন ঝোপঝাড় । এককালের সুনিপুণ কারুকার্যে গড়া এই অট্টালিকায় আস্তানা গেড়েছে বিষধর সাপ আর বাদুড়ের দল । ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে যেতে হয়; যে প্রাসাদের শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে অন্য কারোর প্রবেশের অধিকার ছিলো না এবং তার কারণ ছিলো রাজবংশের আভিজাত্য যা কিনা আজ বিলীন হয়ে গেছে , সেই প্রাসাদেরই প্রবেশদ্বারের উপর আজও বড়ো হরফে লেখা রয়েছে যে রাজবাড়িতে প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ , কিন্তু সেটার কারণ সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে হয়ে গেছে এককালের এই অভিজাত বাড়ির ভগ্নদশা। অদৃষ্টের এই নির্মম কোপে এখন রাত্রিবেলা এই রাজবাড়িটিকে দূর থেকে দেখলে হানাবাড়ি বলে ভুল হবে ।
সত্যিই প্রকৃতির খেলার কাছে পৃথিবীর সব কিছুই যেনো ভীষণই তুচ্ছ । তবুও ইতিহাস লুকিয়ে থাকে ইতিহাসেই ।।
#Happy_world_heritage_day
Information :- Wikipedia & YouTube
Pictures :- Myself Ritajyoti Chakrabarti
#Cossimbazar #bororajbari #murshidabad #history
#photography #architecturephotography #nikond7500 #nikon
#ঋচক্রবর্তী
Comments
Post a Comment