দিদির ভাতের হোটেল
অরুন্ধতী চক্রবর্তী
উফ, বিরক্ত!!... গাড়িটা এখানেই বিগড়োতে হল! চারদিক ধু ধু করছে। সিঙ্গুরের দিকে যাচ্ছিলাম একটা কাজে, আমার নতুন ফ্যাক্টরির জন্য একটা জায়গা দেখতে গেছিলাম। শিবতলা পেরোতেই গাড়ি 'ঘ্যাচ' শব্দ করে থেমে গেলো। এদিকে খিদেতে পেটে ইঁদুর ছুঁচোর দৌড় শুরু হয়ে গেছে। সেই সকালে দুধ,কর্নফ্লেক্স,কলা খেয়ে বেড়িয়েছি... পেটে থাকে নাকি এতোটা সময়? মায়ের হাতের সেই লুচি, সাদা তরকারি বা আলুর পরোটা খেলে অনেকটা সময় পেটে থাকতো। এখন আর সে সবের বালাই নেই। হঠাৎ খিদে পেলে যাতে খেতে পারি তাই মিলি আমার সাথে আমন্ড বাদাম, দুটো বিস্কুট, কয়েকটা কিসমিস এইসব দিয়ে দেয় গাড়িতে। ওইসব ছুলুমছালুম খেয়ে কি আর পেট ভরে? মেজাজটা বিগড়ে গেছে!
"কি হল গোবিন্দ?"
গোবিন্দ আমার গাড়ির চালক। অনেকদিন ধরে আমার কাছে কাজ করছে। খুব কর্মঠ আর বিশ্বাসী। আমার আর একটা গাড়ি আছে, ওটা মিলি নিজেই চালায়। ওর আবার অন্য কেউ গাড়ি চালাবে সেটা পছন্দ নয়, বলে তাতে নাকি প্রাইভেসি নষ্ট হয়।
"মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে দাদা। দাঁড়ান, একটা ফোন করি, কাছেধারেই রবিনের গ্যারাজ আছে। ও এসে দেখে যাক।"
অগত্যা, অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই। গোবিন্দ ফোনে কথা বলছে। আমি গাড়ি থেকে মিলির দিয়ে দেওয়া খাদ্যসামগ্রীর থেকে মনমতো কিছু খুঁজে খাওয়ার বৃথা চেষ্টা করছি! দুপুর প্রায় শেষের দিকে, ভেবেছিলাম একেবারে অফিসে গিয়ে লাঞ্চ করবো। বাড়ি থেকেই লাঞ্চ আসে আমার, মিলি বাইরের খাবার খেতে দেয় না। এখন তো মনে হচ্ছে সে গুড়েও বালি! গোবিন্দরও মনে হয় খিদে পেয়েছে। মুখটা শুকিয়ে গেছে।
"রবিন এখুনি আসছে দাদা, একটু অপেক্ষা করুন।"
কিছুক্ষণ পরে রবিন এলো সাইকেলে করে, একজনকে পিছনে বসিয়ে। গাড়ি পর্যবেক্ষণ করে জানালো,ওরা যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে এখানেই গাড়ি মেরামত করে দেবে, ঘন্টা দেড়েক সময় লাগবে।
উফ, কী জ্বালা... জিজ্ঞেস করলাম অন্য কোনো গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারবে কিনা!... রবিন বললো অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা যাবে না, তবে আশ্বাস দিলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়ি ঠিক করে দেবে।
"গোবিন্দ, ভীষণ খিদে পেয়েছে। তোমারও তো পেয়েছে মনে হচ্ছে!"
"হ্যাঁ দাদা, তা পেয়েছে। কিন্তু এখানে আপনি কোথায় খাবেন? আছে কয়েকটা ধাবা... কিন্তু আপনি তো বাইরের খাবার খান না!"
"কিন্তু না খেয়ে এই পড়ন্ত দুপুরে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার চেয়ে কিছু খেয়ে নিলে হতো না?" ছোটবেলা থেকে আমি খিদে একেবারেই সহ্য করতে পারি না!
গোবিন্দ হাসে। "দাঁড়ান দাদা, রবিন বলতে পারবে এখানে ভালো খাবার দোকান কিছু আছে কিনা... চারিদিকে তো তেমন কিছু চোখেও পড়ছে না... রবিন, এখানে ভালো হোটেল আছে রে?"
"একটা হোটেল আছে গোবিন দা... দিদির ভাতের হোটেল। অনেকদিনের পুরোনো। অপূর্ব রান্নাবান্না। আমরা সময় পেলেই ওখানে খেতে চলে যাই। সোজা গিয়ে সামনেই দেকবে রাজ ধাবা, একটা ঢালু মতো জায়গা আছে,নেমেই দিদির ভাতের হোটেল... "
"পরিষ্কার পরিছন্ন তো?"
"হ্যাঁ গোবিন দা... খুব পোস্কার আর হেব্বি রান্না..."
"কী দাদা, যাবেন নাকি"... গোবিন্দ জিজ্ঞেস করে।
আমার তখন খিদেতে এখন তখন অবস্থা... দুজনে হাঁটা শুরু করলাম। রোদ যেন ভীষণ রেগে গিয়ে ব্রহ্মতালু জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ঢাল বেয়ে এসে নামলাম হোটেলের সামনে। পাকা দেওয়ালের উপর টিনের চাল, মলিনতার ছাপ চারিদিকে। একটা রংচটা টিনের গায়ে সাদা রঙ দিয়ে লেখা 'দিদির ভাতের হোটেল'…
গোবিন্দর মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট।
"এখানে খেতে পারবেন দাদা? নাকি অন্য কোনো জায়গায় যাবেন? বৌদি জানতে পারলে কিন্তু খুব রাগ করবেন।" গোবিন্দসহ আমার অফিসের সবাই মোটামুটি জানে তাদের মালকিন কী অসম্ভব বাড়াবাড়ি করে আমার খাওয়াদাওয়া নিয়ে!
"ধুর, ছাড়ো তো... খিদেয় মরছি!!... এখন খেয়ে বাঁচলে তবে তো তোমার বৌদির সাথে দেখা হবে!"
দুজনে ঢুকলাম হোটেলে...পড়ন্ত বেলায় হোটেল মোটামুটি ফাঁকা। চার পাঁচজন মজুর গোছের লোক তৃপ্তি সহকারে ভাত খাচ্ছে... হোটেলের ভিতরটা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এতটুকুও ধুলোবালি নেই কোথাও। নিপুণ হাতে কেউ যেন সবকিছু যত্নে সাজিয়ে রেখেছে, যেখানে আভিজাত্যের ছাপ নেই কিন্তু আন্তরিকতা আছে। টেবিল চেয়ার পাতা। মাথার উপর পাখার হওয়াটা সত্যিই ভালো লাগছে। একজন কমবয়সী ছেলে তড়িঘড়ি দৌড়ে এসে বসতে বললো... পোশাক আশাকে আন্দাজ করেছে কিছুটা।
"খাবেন তো?"
উত্তরটা গোবিন্দ দিলো। "হ্যাঁ, খাবো। কী পাওয়া যাবে ভাই?"
ততক্ষণে দোকানের মালিকও ছেলেটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মালিকটির বয়সও বেশ কম।
"বসুন স্যার বসুন। সব আছে। ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, ভাজা, মাছ সব আছে।"
গোবিন্দ আমায় একটা আলাদা টেবিলে বসিয়ে নিজে পাশের একটা আলাদা টেবিলে গিয়ে বসেছে।
"আমার পাশের চেয়ারটায় এসে বসো গোবিন্দ। একসাথেই খাবো।"
ইতস্ততঃ করতে করতে গোবিন্দ এসে বসলো আমার পাশটিতে।
"তাহলে কী দেবো স্যার? আমাদের এখানে স্পেশাল মেনুও আছে কিছু!" দোকানের মালিক বললো।
গোবিন্দ লোকটিকে থামিয়ে দিলো। "শুধু মাছ আর ভাত নিয়ে এসো দুটো। কি দাদা, তাইতো?"
বরাবরের খাদ্যরসিক আমি ওই 'স্পেশাল মেনুর' লোভ ছাড়তে পারলাম না। জিজ্ঞেস করেই বসলাম, "তা তোমাদের স্পেশাল মেনুতে কি কি আছে শুনি?"
ছেলেটি দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করলো, "আজ্ঞে, কচুর শাক ছোলা দিয়ে, কচুর লতির সর্ষে ঝাল, শাপলা ভাজা, চিংড়ি দিয়ে মুসুর ডাল, তেতো ছাড়া সুক্তো, থানকুনি পাতার বড়া, পোস্তর বড়া...."
শুনে তো আমার চক্ষু চরকগাছ! বলে কি ছোকরা! এই সব রান্না এখনও হয়? সেই মায়ের হাতের রান্নার কথা মনে করিয়ে দিলো...
জিজ্ঞেস করলাম "এখন ওইসব পাওয়া যাবে কি?"...
ছেলেটি বললো "অবশ্যই, আপনি শুধু বলুন এখন কি কি খাবেন?"
গোবিন্দ যারপরনাই অবাক চোখে আমায় দেখছে।
বললাম, "সুক্তো, চিংড়ি দিয়ে ডাল, কচুর শাক, পোস্তর বড়া... এই আপাতত নিয়ে এসো, পরে বাকিটা বলছি। কি গোবিন্দ চলবে তো?"
গোবিন্দ আমার এই রূপ আগে কোনোদিন দেখে নি। হতবাক হয়ে কথার ভাষা হারিয়েছে বোধহয়।মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো কেবল...
কিছুক্ষণ পরে টেবিলে কলাপাতা আর মাটির গ্লাস দিয়ে গেলো। সঙ্গে নুন, লেবু। গরম ধোঁয়া ওঠা ভালো চালের ভাত, সাথে পোস্তর বড়া,মাটির ছোটো ছোটো বাটিতে সুক্তো,ডাল,কচুর শাক। সুক্তো দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া শুরু করলাম আমরা। আহা, অমৃত। কচুর শাক ছোলা দিয়ে। মুখে দিতেই চমকে উঠলাম! বড়ো পরিচিত এই স্বাদ! একেবারে যেন মা আর রানুদির হাতের তৈরী খাবার। পোস্তর বড়া ভেঙে একটু মুখে দিলাম, হুবহু একই স্বাদ, মুখে দিলেই মিলিয়ে যাচ্ছে!পুরোটা খেতে পারলাম না। চোখে জল চলে আসছে। খাওয়া থামিয়ে দিয়েছি। মুখটা হঠাৎ বিস্বাদ হয়ে গেছে!
"অসুবিধা হচ্ছে, না দাদা?... আমি জানতাম, আপনার এসব জায়গায় খেতে খুব অসুবিধা হবে।" গোবিন্দ অপ্রস্তুত।
"তুমি বসে খাও গোবিন্দ। আমি একটু মালিকের সাথে কথা বলে আসি।"
মালিক অবধি পৌঁছাতে হল না। অপরাধীর মতো মুখ করে মালিক এসে আমাদের টেবিলের সামনে উপস্থিত হল।
"কি অসুবিধা হলো স্যার? খাবার ভালো লাগলো না? অন্য কিছু দেবো?"
আর পারলাম না। উঠে এসে মালিকের হাত দুটো ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনাদের এখানে কে রান্না করে ভাই?"
বেচারা তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।
"কেনো স্যার?"
"প্লিজ বলুন, আমি একবার তার সাথে দেখা করতে চাই।"
"এক বয়স্কা দিদি আছেন। প্রথম প্রথম উনিই রান্না করতেন, এখন আর পারেন না। দু'তিন দিন ছাড়া ছাড়া আসে এখানে, উনিই বলে বলে দেন, দুটি মেয়ে আছে, ওরাই রান্নাবান্না করে।"
"কে, কে তিনি? আমি একবার দেখা করতে চাই ওনার সাথে। ওনার নাম বলতে পারবেন?"
"স্যার, আমরা ওনাকে ননী দি বলেই ডাকি। বাবার আমলের লোক। আগে দোকানের নাম ছিলো নিস্তারিণী হোটেল, আমার ঠাকুমার নামে। খুব একটা চলতও না তেমন। ননী দি আসার পরে হোটেলের পসার অনেক বেড়েছে। অপূর্ব রান্নার হাত ননী দির। দূর দূর থেকেও অনেকে আসে খেতে। একবার যে খেয়েছে সে বারবার আসে স্যার। বাবাও দিদি ডাকতেন, আমিও দিদি ডাকি, সবার দিদি... বাবা হোটেলের নাম বদলে রাখলেন দিদির ভাতের হোটেল। বাবার বয়েস হয়েছে, তাই আমিই বসি। ননী দি আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে। একা বিধবা মানুষ। কালকে আবার আসবে দোকানে।"
নামটা শুনে একটু দমে গেলাম, অপরিচিত নাম, অপরিচিত মানুষ। এভাবে উত্তেজনা না দেখলেই হত। তাও কেমন যেন কৌতূহল দমন করতে পারলাম না। দাম মেটাতে গিয়ে অবাক হলাম, খাবার দাবারের দাম এতো কম? ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করতে সে জানালো খাবারের দাম কম রেখেছে যাতে সবাই খেতে পারে। আর ননীদি নাকি বলেন মানুষকে খাইয়ে যে তৃপ্তি তা নাকি আর কিছুতে নেই। তাই সামান্য দাম নিতে হবে যাতে সবাই খেতে পারে।
অবাক হলাম। বললাম,"আমি কালকে একবার আসবো এখানে। কখন আসবো?"
"স্যার আপনি সকালের দিকটা আসুন। বেলার দিকে ভিড় বাড়তে থাকে। ননী দি সকাল ছ'টা থেকে দশটা অবধি থাকে, তারপর চলে যায়। আমার ফোন নাম্বারটা রাখুন।"
ফোন নাম্বারটা নিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। ততক্ষণে রবিনেরও গাড়ি সারানো হয়ে গেছে। টাকাপয়সা মিটিয়ে গাড়িতে বসেছি। গোবিন্দকে বললাম, "আজকের ঘটনা নিয়ে কারোর সাথে আলোচনা কোরো না গোবিন্দ, কালকে সকাল সাতটায় তৈরী থেকো, আগে এখানে একবার আসবো, তারপর অফিসে ঢুকবো।"
গোবিন্দ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
রাতে বাড়ি এসে মনটা কেমন যেন ভারাক্রান্ত হয়ে রইলো। সামান্য কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। মিলিকে বললাম আজ অনেক কাজ ছিলো, খুব ক্লান্ত। মিলিও কথা বাড়ায় নি। নয়তো, এই সময়টা আমার পরিবারের। মিলি আর আমি সারাদিনের ঘটা বিভিন্ন ঘটনা একে অপরের সাথে ভাগ করে নিই। মেয়েকে ফোন করি। অদ্ভুত স্বভাববের মেয়ে মিলি। বড়ো চাকরি করে, নিজের মতকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। আমাদের একমাত্র মেয়ে সুনয়না বেঙ্গালুরুতে পড়াশোনা করছে। মা মারা গেছেন প্রায় সাত বছর হল। বিয়ের পর মিলি এসেই মায়ের হাত পুড়িয়ে রান্না করাটা বন্ধ করে দিলো। মা খুব চুপচাপ ছিলেন বলে প্রতিবাদ করেন নি কোনোদিন, কিন্তু মনে মনে কষ্ট পেতেন। রান্নাঘরটা ছিলো মায়ের জগৎ। মিলির মতে রান্না করা ছাড়াও মানুষের করার মতো আরো অনেককিছু আছে। মায়ের ঘরে আলাদা টিভি এলো, মায়ের জন্য নানা রকমের বই এলো, সেলাইয়ের বিভিন্ন উপকরণ এলো। তাও মা কেমন যেন মনমরা হয়ে যেতে লাগলেন। মায়ের হাতে বানানো সাবেকি রান্নাগুলো মোটামুটি তখন থেকেই বন্ধ হল। রান্নার লোক মিলির আদেশ অনুসারে রান্না করতো। প্রথম প্রথম সেই রান্না আমার বা মায়ের মুখে রুচতো না! কিন্তু অগত্যা খেতেই হতো। একেবারেই তেল মশলা ছাড়া রান্না খাওয়া অভ্যেস করতে আমাদের বেশ খানিকটা সময় লেগেছিলো। স্যুপ আর স্টুতেই আমার জীবনটা ঘুরপাক খেতে লাগলো।
মা ছিলেন যৌথ পরিবারের বড়ো বউ। বিয়ের পরেই অলিখিত ভাবে সংসারের প্রায় সব দায়িত্ব এসে বর্তায় মায়ের কাঁধে। মা হাসিমুখে সবটা সামলাতেন। আমার যখন বছর তেরো বয়েস, তখন মায়ের রান্নার কাজে সাহায্য করতে গ্রাম থেকে মামাবাবু নিয়ে আসেন রানু দিকে। রোগা ছিপচিপে একটা বছর কুড়ির মেয়ে। চোখ দুটো বেশ বড়ো বড়ো, সপ্রতিভ,অবাক দৃষ্টি, হাসিমুখ। সবসময় মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরতো, মাকে বড়দি বলে ডাকতো। মাকে রান্নায় সাহায্য করতো। একবার আমার খুব জ্বর হয়েছিলো, মনে আছে রানুদি অনেক রাত পর্যন্ত বসে বসে জলপট্টি দিচ্ছিলো। সারাদিন ব্যস্ত ক্লান্ত থাকা আমার মাকে এভাবে অনেক সাহায্য করতো রানুদি। মায়ের কাছেই রানুদির রান্নায় হাতেখড়ি। কিছুদিনের মধ্যেই দারুণ রান্না শিখে গেলো, খুব আগ্রহ নিয়ে শিখতো প্রতিটি রান্না।
একদিন কাকিমার গলার সোনার হারটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না, স্নান করার সময় চৌবাচ্চার ধারে খুলে এসেছিলেন। তারপরেই রানুদি স্নানে গেছিলো। চুরির দায় এসে পড়লো রানুদির উপর। এ বাড়িতে রানুদির উপর মায়ের ভালোবাসা অনেকের কাছে আদিখ্যেতার সমান ছিলো। অনেক কান্নাকাটি করেছিলো রানুদি, তার থেকেও বেশি কেঁদেছিলো মা। কেউ বিশ্বাস করেনি সেদিন রানুদিকে। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। সেই রাত টা আমাদের বাড়িতে কাটিয়ে ভোরবেলা বাবার সঙ্গে গ্রামে আমার মামারবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো রানুদিকে। মা দু'দিন ভাতের দানাটুকু কাটে নি মুখে। বেশ কিছুদিন পরে অবশ্য হারটা পাওয়া গেছিলো চৌবাচ্চা পরিষ্কার করতে গিয়ে। ভরা চৌবাচ্চার এক কোনায় পড়ে গেছিলো হারটা, কারোর চোখে পড়ে নি। কিন্তু রানুদিকে আর পাওয়া যায় নি। হার পাওয়া যাওয়ার পরে মা বাবা আমার মামাবাড়ি গেছিলেন। কিন্তু রানুদির পরিবার অন্য কোথাও চলে গেছে জানতে পেরেছিলেন।
সকাল সকাল তৈরী হয়ে জলখাবার খেয়ে গোবিন্দকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম গন্তব্যে। তখন দোকান মোটামুটি ফাঁকা। মালিক ছেলেটি আমায় দেখেই এগিয়ে এলো।
"আসুন স্যার, বসুন, আমি ননী দিকে ডেকে আনি। বলেছি ওনাকে আপনার কথা।"
কিছু পরে এক শীর্ণকায়া মহিলা সামনে এলেন। পরনে সাদা থান, কাঁচা পাকা চুল, মুখে বয়েসের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু ওই চোখ দুটো দেখে মুহূর্তে চিনতে দেরি হল না রানুদিকে....
"চিনতে পারিস রানু দি?" বয়েসে বেশ খানিকটা বড়ো হলেও আমি রানুদিকে তুই করতাম...
দৃষ্টি কমে এসেছে। চোখ ছোটো করে কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে রানুদি।
"বিলু, আমার বিলু... কেমন আছিস?"
"তুইই তাহলে এদের ননী দি... তোর হাতের রান্নার স্বাদ তোকে চিনিয়ে দিলো রে... কোথায় হারিয়ে গেছিলি রানুদি? কতো খুঁজেছি তোকে!"
চোখের জল বাঁধ মানছে না আমাদের ।
"বড়দি, বড়োবাবু কেমন আছে বিলু?"
"বাবা চলে গেছেন বহুদিন হল রে... মাও চলে গেছেন প্রায় সাত বছর হয়ে গেলো। চল রানুদি আমার সাথে আমার বাড়ি চল, তোকে মাথায় করে রাখবো।"
"তা হয় না রে বিলু... এরা আমার বড়ো আপন, বহু বছর এদের সাথেই মিলেমিশে আছি, এরা যে বড়ো ভালোবাসে আমায়!ছেড়ে যেতে পারবো না কোথাও। তুই বরং মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যাস।"
"তোর তো বয়েস হয়েছে রানুদি... কষ্ট হয় না রান্না করতে?"
"ওরে বড়দি বলতো, রানু, এই রান্নাঘরেই আমাদের মোক্ষলাভ হয় রে, এখানেই আমাদের মুক্তি... রান্না করে সবাইকে খাওয়ানোর যে কী সুখ রে! আর নিজে হাতে কিছু করি না এখন, শুধু বড়দির শেখানো রান্নাগুলো এদের বলি, এরাই করে।"
হোটেলের রাঁধুনি, কর্মচারী সবাই কখন যে আমাদের ঘিরে আছে খেয়াল করিনি। মালিক ছেলেটি অবাক চোখে চেয়ে দেখছে আমাদের... গোবিন্দও অবাক!
"কি সুন্দর লাগছে রে তোকে বিলু... বিয়ে থা করেছিস? কটা ছেলে মেয়ে?"
"সবকিছু কি এখানে দাঁড়িয়েই শুনবি রানুদি? আজ চল আমার বাড়ি, কটা দিন থাক, প্রাণ খুলে তোর সাথে একটু কথা বলি!"
"নারে বিলু, আজ নয়, তবে অবশ্যই যাবো তোর সংসার দেখতে।"
মনে হাজারও প্রশ্ন নিয়ে সেদিন চলে এসেছিলাম বাড়িতে। রানুদি আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর কি হল? গ্রাম থেকে সপরিবারে চলে গেছিলো কেনো? কলকাতায় কীভাবে পৌঁছালো? এই কাজ কতদিন ধরে করছে? রানু নামের বদলে ননী নামটি ব্যবহার করে কেনো? বাড়িতে কে কে আছে... অনেক প্রশ্ন!
দোকানের মালিককে ফোন করে রানুদির বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়ে একদিন বিকেলের দিকে গোবিন্দকে সাথে নিয়ে চলে গেলাম রানুদির বাড়ি। বাড়িতে চারিদিকে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। আপ্যায়নের ত্রুটি হল না এতটুকুও। একটি ছেলেকে দিয়ে কিছু আনালো। না করলেও শোনে নি! প্লেটে আমায় আর গোবিন্দকে সাজিয়ে মিষ্টি দিলো।
"আমি এখন মিষ্টি খাই না রানু দি... সুগার। আচ্ছা, একটা খাচ্ছি..."
"তবে থাক, দাঁড়া, আমি তোর জন্য চিনি ছাড়া চা আর তোর প্রিয় কালোজিরে শুকনোলঙ্কা দিয়ে মুড়ি ভেজে আনি..."
"কিচ্ছু করতে হবে না রানুদি... তুই আমার কাছে বস একটু।"
গোবিন্দ ততক্ষণে মিষ্টি খেয়ে বাইরে চলে গেছে।
"আমি জানি বিলু তোর মনে অনেক প্রশ্ন... বড়োবাবু আমায় গ্রামে দিয়ে আসার পর কোনোভাবে গ্রামে রটে যায় যে চুরির দায়ে আমায় শহরে কাজের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে... লজ্জায় টিকতে পারলাম না গ্রামে। বাবা আমাকে আর মাকে নিয়ে চলে এলো কলকাতায়। এখানে একটা কারখানায় কাজ নিলো বাবা। মা দুই বাড়ি রান্নার কাজ করতো। এখানে থেকেই বিয়ে হল আমার। ভালোই ছিলাম, তোর জামাইদাদা খুব ভালোবাসতো আমায়। ড্রাইভারি করতো।ছেলেপুলে হল না। আমায় ননী বলে ডাকতো তোর জামাইদাদা। ও মারা যাওয়ার পর আমি তিনটে বাড়িতে রান্নার কাজ নিলাম, পেট চালাতে হবে তো! তারপর এখন যাদের হোটেল তাদের বাড়িতেও রান্না করতাম। আমার রান্না খেয়ে বড়কর্তা আমায় নিস্তারিণী হোটেলে রান্নার কাজে বহাল করলেন। সেই থেকেই ওখানে কাজ করি। এখন বড়োকর্তা হোটেলে যেতে পারেন না, ছেলে বসে। বড়কর্তা ননী দি ডাকে, সবাই ওই নামেই ডাকে। রানু নামটা আমি নিজেই ভুলে গেছি রে। বড্ড ভালোবাসে আমায়। হোটেলের নাম বদলে দিদির হোটেল নাম রেখেছে... বলে ননী দি, তুমি না থাকলে আমার হোটেলের যে কী হাল হতো!তুমি আমার নিজের দিদির মতোই..."
হাঁ করে রানুদির কথা শুনছিলাম। আমার জিদ ধোপে টিকলো না... রানুদিকে কিছুতেই আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে পারলাম না! আমার পরিবার যে অন্যায় রানুদির সাথে করেছে তার দায় এড়াবো কী করে? বললাম, "রানুদি আজ আমাদের জন্যই তোর এই অবস্থা...আমি তোর জন্য কিছু করতে চাই, চল আমার কাছে, আমার কাছে থাকবি। বাকি জীবনটা অন্তত একটু সুখে কাটা!"
রাজি হল না রানুদি...
"ওরে পাগল, এখন খারাপ আছি নাকি? খুব ভালো আছি রে... এরা আমায় যা টাকা দেয় একা মানুষ আমি, খুব ভালো চলে যায় আমার... তোর জামাইদাদা মারা যাওয়ার পর বড়কর্তা আমায় আগলে আগলে রেখেছে রে! এদের ছেড়ে যেতে পারবো না রে বিলু।"
হোটেলের মালিক ছেলেটিকে অনুরোধ করেছিলাম আমি টাকা পয়সা দেবো, হোটেলটাকে আরো বড়ো করুক ওরা, আর রানুদিকে যেন মাসের টাকাটা বাড়িয়ে দেয়। ছেলেটি টাকা নিতে রাজি হয়নি। আর জানিয়েছে রানুদিকে টাকা বাড়ানোর কথা বলেছিলো, রানুদি বাড়তি কোনো টাকা নিতে রাজি হয়নি।
মিলিকে গল্পচ্ছলে রানুদির কথা বলেছিলাম। চোখে মুখে কোনো আগ্রহ দেখি নি...চোখ আর মনটা ছিলো মোবাইলে! একবার শুধু বলেছিলো কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করে দিও, গরীব মানুষ তো!
আর কথা বাড়াইনি!
রানু দিকে একটা ফোন কিনে দিয়েছি, নিতে চায় নি... জোড়াজুড়িতে নিয়েছে আমার সাথে কথা বলার লোভটা শুধু ছাড়তে পারবেনা বলে।
মাঝে মাঝে গোবিন্দকে নিয়ে দিদির ভাতের হোটেলে যাই। হোটেলের মালিক ছেলেটির নাম তরুণ। তরুণও খুব খুশি হয় আমরা গেলে। যেদিন যাই তার আগের দিন রানুদিকে জানিয়ে যাই। সেদিন হোটেলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রানুদি খাওয়ায় আমায় আর গোবিন্দকে। সে স্বাদ অমৃততুল্য... মায়ের হাতের ছোঁয়া পাই সেখানে। সেদিনগুলো আমার খাবারে কোনো বাদ বিচার থাকে না। তৃপ্তি করে বহু পদ দিয়ে অনেকটা ভাত খাই। গোবিন্দ মানা করে। আমি অগ্রাহ্য করি। ধুর, ভালোবাসার কাছে প্রেসার, সুগার সব হার মানে!
রানুদির বাড়িতেও যাই। প্রাণ খুলে দুই ভাইবোনে গল্প করি। নির্লোভ আমার এই দিদিটার বাড়িতে যেদিন যেদিন আসি সেদিনগুলি আমায় ঘুমের ওষুধ খেতে হয় না।
রানুদির মধ্যে আমি আমার মাকে খুঁজে পেয়েছি, রানুদিকে আর কোথাও হারিয়ে যেতে দেবো না। বড্ড ভালোবাসি আমি আমার এই অভাগা দিদিটাকে।
Read Story, I promise that you have to cry after that, if you have a good and very kind heart and mind...
ReplyDeleteThe story is not good,it is too big .I couldn't read this .I not cry after read this book.
DeleteThen it means that you have not a kind heart and good mind. You have so much concentration. Try to concentrate doing YOGA.
ReplyDelete