- "স্যার, খুব খিদে পেয়ে গেছে। জেলের একঘেয়ে খাবার তো রোজই খাই, ফিরে গিয়ে সেটাই জুটবে। আজ কচুরি-সিঙ্গাড়া খেতে খুব ইচ্ছে করছে, দিন না একটু ব্যবস্থা করে সামনের দোকান থেকে... ...."
এজলাসে উপস্থিত পুলিশ-উকিল-মোক্তারদের হতচকিত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন যুবক। কোর্ট লক-আপের ভিতরে দাঁড়িয়ে ফের আর্জি জানান ভালমন্দ খাওয়ার।
- জানি স্যার, নিয়ম নেই। কিন্তু একদিন না হয় একটু নিয়ম ভাঙলেন। অস্ত্রশস্ত্র তো আর চাইছি না, সামান্য কচুরি-সিঙ্গাড়া। আর হ্যাঁ, কয়েকটা রসগোল্লা হলে ভাল হয়। শেষে একটু মিষ্টিমুখ আর কী...
পুলিশ কর্তা টেগার্টকে আসামির আর্জি জানাতে বললেন, “ ফাঁসি তো হবেই ওর। যা খেতে চাইছে, দাও। খুশি থাকুক, ওকে একটু দরকারও আছে আমাদের।”
আদালতে যখন মধ্যাহ্নভোজের বিরতি, প্লেটে করে কচুরি-সিঙ্গাড়া-রসগোল্লা সাজিয়ে দেওয়া হল তাঁর সামনে। দিব্যি গুছিয়ে বসে খেলেন পেটপুরে এবং বিরতির পর নিশ্চিন্তে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লেন নিয়মরক্ষার দণ্ডাদেশ শুনতে। জানাই তো আছে, কী সাজা ঘোষণা করতে চলেছেন বিচারক!
ঘড়ির কাঁটা সেদিন সাড়ে পাঁচটার দোরগোড়ায়। কলকাতার অফিসফেরতা মানুষের ভিড় থমকে গেল আচমকাই, স্তব্ধ হয়ে দেখছে রিভলভার হাতে উর্ধশ্বাস দৌড় এক যুবকের। যার সঙ্গে ব্যবধান দ্রুত কমে আসছে তাড়া করে আসা পুলিশ বাহিনীর। যুবকের হাতে উদ্যত রিভলভার। মাঝেমাঝেই পিছন ফিরে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছে, “খবরদার!”
দম ফুরিয়ে আসছে। মাথাও আর কাজ করছে না যুবকের, পুলিশ ধরে ফেলল বলে। কী করবে এখন? কী করা উচিত? আরে, উল্টোদিক থেকেও তো দু’জন ছুটে আসছে। গায়ে উর্দি, মানে পুলিশ! এবার?
রিভলভার নিজের মাথায় ঠেকানোর আগেই পুলিশ যুবকের হাত চেপে ধরলেন। পিছনের পুলিশবাহিনীও ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সুযোগ পেলেন না যুবক। ধরা দিতে হল। রিভলভার, কার্তুজ এবং ছোরা বাজেয়াপ্ত হল সব।
“তুমি সরকারের শ্যাম, আমাদের শূল
তোমার ভিটেয় চরবে ঘুঘু দেখবে চোখে সরষে-ফুল।” 🐦🐦
ছড়াটা তখন মুখে মুখে ফিরত বাংলার বিপ্লবীদের। বানানো হয়েছিল ডাকসাইটে ডেপুটি সুপার সামসুল আলমকে নিয়ে | আলিপুর বোমার মামলায় পুলিশের তরফে সরকারি কৌঁসুলি মিস্টার নর্টনের ডান হাত ছিলেন সি.আই.ডি-র এই D.S.P যেখানে দশ বাঙালি বিপ্লবীর হয়েছিল কঠিন সাজা। শুধু এখানেই নয়, রাষ্ট্রদ্রোহের যে কোন মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ঘুঁটি সাজানোয় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল সামসুল মিঞার। মিথ্যে সাক্ষী জোগাড় করায় যেমন করিতকর্মা, তেমনই পটু কচিকাঁচাদের মগজধোলাই করে ‘রাজসাক্ষী’ হতে রাজি করানোয়।
এ হেন পুলিশ অফিসার যে দ্রুত বিপ্লবীদের খতমতালিকায় ঢুকে পড়বেন, প্রত্যাশিতই ছিল।
সামসুল-হত্যার দায়িত্ব দাদা মানে বাঘা যতীন দিলেন তাঁর বিশেষ স্নেহভাজন এক যুবককে। যুবকের জন্ম ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম। পাথরে কোঁদা চেহারা।! 🏵️
২৪শে জানুয়ারি ১৯১০.......
সামসুল দুপুরের একটু পরে এসেছেন হাইকোর্টে। নর্টন সাহেবের ঘরে বসেছেন অন্যদিনের মতোই। সঙ্গে এনেছেন একগুচ্ছ ফাইলপত্র, যাতে গচ্ছিত রয়েছে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। আলোচনা শেষ হল বিকেল পাঁচটা নাগাদ। দেহরক্ষীকে প্রস্তুত হতে বললেন সামসুল।
একটু পরেই বেরুলেন সরকারি কৌঁসুলির ঘর থেকে। সামনে হাঁটছেন অ্যাডভোকেট জেনারেল, যিনিও নর্টন সাহেবের ঘরে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। পিছনে সশস্ত্র দেহরক্ষী। পূর্ব দিকের সিঁড়িতে প্রথম পা রাখতে যাবেন, সাক্ষাৎ যমদূতের মতো মুখোমুখি হাজির হলেন যুবক।
অল্পবয়সী আগন্তুকের এভাবে পথ আটকে দাঁড়ানোয় ক্ষণিকের জন্য অপ্রস্তুত সামসুল। দেহরক্ষী ততক্ষণে দেখে ফেলেছেন, যুবক পরনের ফতুয়ার মধ্যে থেকে বার করছেন রিভলভার। বাধা দেওয়ার আগেই ‘দ্রাম’! করমর্দনের দূরত্ব থেকে গুলি চালিয়ে দিয়েছেন । সামসুলের বক্ষস্থল ভেদ করল বুলেট, ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার আগে শুধু অস্ফুটে বলতে পেরেছিলেন, “পাকড়ো”! 💥
পাকড়াতে ধাওয়া করল পুলিশ। আদালত চত্বর এবং আশেপাশের এলাকায় তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। সামসুলের গুলিবিদ্ধ প্রাণহীন দেহকে ঘিরে যেমন ভিড় জমে গেছে, তেমনই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে বাইরে। “খুন! খুন!” চিৎকারে আতঙ্ক গ্রাস করেছে হাইকোর্টের বাইরের রাস্তাকে। যেখানে চকিত ক্ষিপ্রতায় নেমে এসেছেন যুবক। দৌড়ে পালাচ্ছেন।
কিন্তু ওই জনাকীর্ণ এলাকায় পালাবেন কোথায়? অশ্বারোহী পুলিশ তাড়া করেছে | হাইকোর্টের পাশের ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রীট ধরে ছুটতে ছুটতে যখন যুবক পৌঁছলেন হেস্টিংস স্ট্রীটে। দম ফুরিয়ে এসেছে। মাথা কাজ করছে না আর। পিছনে যারা তাড়া করছে, তাদের সঙ্গে ব্যবধান তো কমে এসেছেই, উল্টোদিক থেকেও দেখতে পাচ্ছেন কয়েকজন পুলিশকে দৌড়ে আসতে।
মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন যুবক। দ্বিধা কাটিয়ে যখন স্থির করলেন, আত্মহত্যাই শ্রেয়, ততক্ষণে একজন সার্জেন্ট উল্টোদিক থেকে তার হাত ধরে ফেলেছেন |
সামসুল-হত্যার নেপথ্যের চক্রীদের পরিচয় জানতে বিরামহীন নির্যাতন চলল যুবকের উপর। জিজ্ঞাসাবাদে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করলেন সি.আই.ডি এবং স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের পোড়খাওয়া অফিসাররা। বৃথা চেষ্টা, যুবক মুখ খুললেন না। বাজিয়ে গেলেন একই কাটা রেকর্ড, “ডি.এস.পি সাহেবের উপর রাগ ছিল, উনি বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে অত্যাচার করেন বলে। যা করেছি, একাই করেছি। কারোর নির্দেশে নয়। প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম, নিয়েছি।”🛑
হাইকোর্টে বিচার চলাকালীন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো উকিলের সাহায্য নিতেও তিনি অস্বীকার করেন। বিচারপতি লরেন্স জেঙ্কিন্স ব্যারিস্টার নিশীথ সেনকে তাঁর উকিল হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু বিপ্লবীদের গুপ্ত সংবাদ প্রকাশ হওয়ার আশঙ্কায় তিনি নিশীথ সেনকে একটি কথাও জানাতে সম্মত হননি। শেষমেশ আদালতে নিশীথ সেন তাঁকে বিকৃতমস্তিস্ক বলে উল্লেখ করেন, তাতেও ঠেকানো গেল না ফাঁসির আদেশ।
২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯১০, আলিপুর জেলে ফাঁসি হয়ে গেলো বাংলা মায়ের এক দামাল ছেলে বীরেন্দ্র নাথ দত্তগুপ্তের। বয়স হয়েছিল মাত্র একুশ!
🌹🌹
তথ্য সৌজন্যে: অচেনা লালবাজার
Comments
Post a Comment