Skip to main content

মহালয়া

শুভ মহালয়া উইস করবেন না, প্লিজ।

মহালয়া আর মহিষাসুর বধ এক নয়। মহালয়ার সাথে মহিষাসুরমর্দিনীর কোন সম্পর্ক শাস্ত্র মতে নেই। যোগাযোগটা নিছক আকাশবাণীর তৈরি করা।

 “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীমছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবমাধুরীর সঞ্জীবন। তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন। আজ চিচ্ছক্তিরূপিণী বিশ্বজননীর শারদশ্রীবিমন্ডিতাপ্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।”

সেই ১৯৩১ সাল থেকে এই ডাক শুনলেই বাঙালীর পুজো-পুজো দিন গোনা শুরু হয়ে হায়। যদিও প্রথমে যেদিন লাইভ হয়েছিল সেদিন ছিল মহাদুর্গাষষ্ঠী। পড়ে শ্রোতাদের অনুরোধে পরিবেশনের সময় ঠিক করা হয় মহালয়ার দিন। সম্প্রচারের আগের দিন নাকি দিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সারারাত থেকে যেতেন আকাশবাণী ভবনে আর অন্যান্যদের গাড়ি পাঠিয়ে মাঝ রাতে সময় বাড়ি থেকে তুলে আনা হত। যে বাঙালী আজ লেট নাইট পার্টি করে বেলা অবধি ঘুমায়, সেও বোধহয় এই মহালয়ার ভোরে উঠে পড়ে পঙ্কজ মল্লিক, বানীকুমার, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আরতী মুখোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ, বিমল ভূষণ, উৎপলা সেন, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণা দাশগুপ্ত, সুমিত্রা সেন, অসীমা ভট্টাচার্য, শিপ্রা বসু আর সর্বোপরি প্রবাদপ্রতীম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের টানে।

এই মহালয়া মানে পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবীপক্ষের শুরু, বাঙালীর চল প্যান্ডেলের প্রস্তুতি, উমার মতন পরবাসীদের ঘরে ফেরার চিঠি, উৎসবের আয়োজন।

হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী পিতৃপক্ষ শুভকার্যের জন্য প্রশস্ত নয়। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরের পূর্ণিমাতে (ভাদ্রপূর্ণিমা) এই পক্ষের সূচনা হয় আর শেষ হয় মহালয়া অমাবস্যা বা মহালয়া দিবসে। উত্তর ভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয়।জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। তখন নাকি, পূর্বপুরুষগণ পিতৃলোক পরিত্যাগ করে তাঁদের উত্তরপুরুষদের গৃহে অবস্থান করেন। এর পর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তাঁরা আবার পিতৃলোকে ফিরে যান।কিন্তু কি এই পিতৃ লোক? এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি অবস্থিত। পিতৃলোকের দেবতা যম। তিনিই মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। অনেকটা বংশানুক্রমিক ভাবে অ্যাজ সিংহাসন অধিকারের মতন এই চক্রাকার আবর্তন চলতে থাকে।

মহাভারতে আছে কর্ণ ছিলেন দানবীর, মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে গেলে, তাঁকে খাদ্য হিসেবে সোনা, মনি, মানিক্য, রত্ন দেওয়া হয়। বিস্মিত কর্ণ ইন্দ্রকে কারণ জানতে চাইলে ইন্দ্র জানান, কর্ণ সারা জীবন ধরে এই সবই দান করেছেন, তিনি কোনোদিন তাঁর পিতৃপুরুষ কে অন্ন দান করেননি। তাই স্বর্গে তাঁকে সোনা দানাই খাবার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। আসলে কর্ণ সঠিক ভাবে নিজের পিতৃ পরিচয় কোনদিন জানতেই পারেন নি তাই তাঁর এই অনিচ্ছাকৃত ভুল সংশোধনের সুযোগ করে দেওয়া হয়।কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার বিধান দেওয়া হয়।সেই মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা।

হিন্দু পুরাণে মতে সূর্যের যখন উত্তরায়ণ বিষ্ণুলোকে দিন, আর যমলোকে তখন রাত। উত্তরায়ণের এই ছয় মাস দেবতারা জেগে থাকেন, তাই বিষ্ণুলোকের দ্বার থাকে অবারিত। দক্ষিণায়নের সময় দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। কিন্তু যমলোকে তখন ঝকঝকে দিন। দক্ষিণায়নের প্রথম দিনে ঘুম ভেঙে উঠে পিতৃপুরুষেরা চলে আসেন। সে অর্থে মহালয়া মর্ত্যলোকে পরলোকগত পিতৃগণের কিছুক্ষণের ঠাই। দুর্গোৎসবের তিন পর্ব তাই মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা। মহালয়ায় পিতৃপক্ষ সাঙ্গ করে দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা শুরু হয়।ওদিনেই তাই উৎসবের শুরু।

হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে দুর্গাপূজোর বিধিসম্মত সময় হল চৈত্র মাস; যে পূজা বাসন্তীপূজা নামে পরিচিত।রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য দুর্গাপূজা করেছিলেন বসন্তকালেই। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে রাজা সুরথ চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথিতে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন।কারন এই সময় মানে বসন্তকাল উত্তরায়ণের অন্তর্গত, তখন দেবতারা জাগ্রত থাকেন তাই বাসন্তীপূজায় বোধনের প্রয়োজন হয় না।শরতের এই পুজো তাই অকাল বোধন।শরৎকাল দেবলোকে রাত তাই এই সময় দেবপূজা করতে হলে, আগে দেবতার বোধন  বা জাগরন প্রয়োজন। রামায়ণে বলা হয়েছে, রাবণ বধের আগে রাম (মতান্তরে ব্রহ্মা) দেবী দুর্গার কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে অসময়ে দুর্গাপূজা করেছিলেন।কথিত আছে- শ্রীরামচন্দ্র ১০৮ টি পদ্ম দিয়ে দেবীপূজার সঙ্কল্প করেন। দেবী ভক্তের ভক্তি পরীক্ষা করার জন্য ছলনা করে একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। পূজার সময় একটি পদ্ম কম হওয়ায় শ্রীরামচন্দ্র পড়লেন বিপদে। সেজন্য তিনি নিজের একটি চোখ তুলে করে তা মায়ের শ্রীচরণে অঞ্জলি দেবেন- এরূপ সঙ্কল্প করলেন। আর তিনি ধনুর্বাণ হাতে নিতেই দেবী আবির্ভূত হয়ে তাঁকে অভীষ্ট বর দিলেন।

‘যা দেবী সংবর্ভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’ যে দেবী সর্বপ্রাণীতে মাতৃরূপে অবস্থিতা তাঁকে নমস্কার জানিয়েই তো শুরু হয় বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসবের।চণ্ডীতে আছে, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেই মায়ের নাম হয়েছিল দুর্গা।আমাদের দৈনন্দিন নিরাপত্তাহীনটা, স্বার্থপরতা, হিংসা, মিথ্যার আসুর কে বধ করে ঘন মেঘের আঁধার ভেদ করে শারদ-সূর্যের প্রকাশের মতো আমাদের জীবন মধুময় করে তোলার রুপক এই দুর্গা পুজো। তাই তাঁর কাছে আমরা বলি-

মধুকৈটভবিধ্বংসি বিধাতৃ-বরদে নমঃ।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।

 

এই দূর্গা পুজো কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে দেবীমাতা, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। মারকন্ডিয় পুরান মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথা খ্রীষ্ট্রের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে নামে দূর্গা পুজোর প্রচলন হয়। মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে দূর্গা পুজোর উল্লেখ আছে। বিদ্যাপতির দূর্গাভক্তিতরঙ্গিনীতেও দূর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিল বলে মনে করা হয়। ১৭৯০ সালের দিকে এই পূজার আমেজে আকৃষ্ট হয়ে পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তি পাড়াতে বার জন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে প্রথম সার্বজনীন ভাবে আয়োজন করে বড় আকারে দূর্গা উৎসব।এখনকার দূর্গা পুজোর প্রাথমিক ধাপ ১৮ শতকে জমিদার, বড় ব্যবসাযী, রাজদরবারের রাজ কর্মচারীদের উৎসাহে চালু হয়। উরিষ্যার রামেশ্বরপুরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দূর্গা পূজা হয়ে আসছে বলে শোনা যায়।। ১৯১০ সালে সনাতন ধর্মউৎসাহিনী সভা ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট লেনে এবং একই জেলায় অন্যান্যরা রামধন মিত্র লেন, সিকদার বাগানে একই বছরে ঘটা করে প্রথম বারোয়ারী পুজার আয়োজন করে।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে দূর্গা পূজা হত বলে শোনা যায়। ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। ধারণা করা হয়, দশম শতকে এখানে বৌদ্ধ মন্দির ছিল যা পরে সেন আমলে হিন্দু মন্দির হয়েছিল এবং একাদশ শতক থেকে এখানে কালী পূজার সাথে দূর্গা পূজোও হত।

বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা। দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভূম রাজ্যের রাজরাজেশ্বরীমূল্ল রাজবংশের কুলদেবী। মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন। এখানকার পূজা পদ্ধতি বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজার থেকে অনেকটাই আলাদা; কিছুটা আলাদা এখানকার দুর্গাপ্রতিমার গড়নও। মৃন্ময়ী দেবী সপরিবারা বটে, কিন্তু লক্ষ্মী-গণেশ ও কার্তিক-সরস্বতী এখানে স্থানবদল করে থাকে। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর স্থলে গণেশ ও গণেশের স্থলে লক্ষ্মী এবং কার্তিকের স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক। এই রূপে দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের রীতিকে জগৎমল্ল-প্রথা বলা হয়। বাঁকুড়া জেলার অনেক প্রাচীন পরিবারেও জগৎমল্ল-প্রথায় নির্মিত দুর্গামূর্তি পূজিত হয়। মল্ল রাজবাড়ির পূজায় দেবী পটের যে ব্যবহার স্বতন্ত্র। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন।

 

১৪৮০ সালে বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম রাজা রাজশাহীর কংস নারায়ণ তাহেরপুরের তাহের খানকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। যুদ্ধজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে রাজ পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শে রাজা কংস নারায়ণ দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। তার আহ্বানে মা দুর্গা স্বর্গ থেকে সাধারণ্যে আবির্ভূত হন। সেই সময় ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে কংস নারায়ণ প্রথম যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন, সেই প্রতিমা ছিল সোনার তৈরি। তার আয়োজনে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের (৮৮৭ বঙ্গাব্দে) বাংলা আশ্বিন মাসে মহাষষ্ঠী তিথিতে দেবীর বোধন হয় রাজপ্রাসাদের আঙিনায় (বর্তমানে তাহেরপুর কলেজ মাঠ)। পূজামণ্ডপ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় সেই সময় থেকেই। তাহেরপুরে এর আগেও দুর্গাপূজা হতো, তবে তা হতো পারিবারিকভাবে। প্রথমবারের পূজার আনুষ্ঠানিকতা ছিল বিপুল। সোয়া ৫০০ বছর আগের ওই উত্সবে খরচ হয়েছিল ৯ লাখ টাকা। পরে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাদুরিয়ার (রাজশাহী) রাজা জয় জগৎ নারায়ণ প্রায় ৯ লাখ টাকা ব্যয় করে বাসন্তী দুর্গোৎসব করেন।দুর্গাদেবীর প্রতিমা গড়েছিলেন ওই পূজার পুরোহিত রাজপণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী। উত্সব চলেছিল এক মাস ধরে। এরপর থেকে রাজপরিবার প্রতিবছর আশ্বিন মাসে এ পূজার আয়োজন করতে শুরু করে।মাসব্যাপী যাত্রা, সার্কাস, পালাগানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়েছিল ওই উৎসবে। এরপর থেকেই ভারত বর্ষসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সার্বজনীন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে শারদীয় দুর্গোৎসব। মহালয়ার দিন কংস নারায়নের দুর্গাপূজা প্রচলনের খবর প্রচার হয় আকাশবানী কলকাতা থেকেও।

মোদ্দা কথা মহালয়া মোটেও শুভ জন্মদিন টাইপের নয়। দুম করে হোয়াটস‍্যাপে শুভ মহালয়া মেসেজ করে ফেলবেন না যেন। তবে যদি কচকচানি বাদ দেন, তবে আদতে মহালয়া কিন্তু আমাদের আমোদের এপিলগ‌। তাই গড়পরতা শুভ মহলয়া উদযাপনের দোষ বাঙালি নিজ গুনে মাফ করে নিয়েছে। 

উমাকে কৈলাশ থেকে এই ধরাধামে টেনে আনতে বাঙালীরা বিস্তর মেলোড্রামা করেছে। ইমোশানে ঠাসা আগমনী গান গেয়েছে,নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর আঁকে বাঁকে চলা নদীর চরায় কাশফুল উড়িয়ে হর-পার্বতীর দাম্পত্যে উঁকিও দিয়েছে। যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী,উমা বড় দুঃখে রয়েছে এমন একটা স্ট্যাটাস ছড়িয়ে জোর করে টেনে আনাটাকে গ্লোরিফাই করেছে। আইনস্টাইনের দিব্যি, শরতে এই অকাল বোধনে যত হ্যাপা সব কিন্তু  গৌরীদেবী আর তাঁর পরিবারের। মহাজাগতিক স্পেস আর টাইমের যে পঞ্জিকিত হাইপোথিসিস আছে তাতে বলছে, এই সময় স্বর্গলোকে রাত্রি। তাই কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে রাবণ বধের অছিলায় বেমক্কা দুগ্গাকে ডেকে আনার ট্রাডিশন আজও চলছে। 

পুজোর গন্ধ এসেছে বলে আদিখ্যেতা করার মতন কিছু নেই। ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে যে শিউলি বিছিয়ে থাকে না তা বলাই বাহুল্য। গন্ধ বলতে রেল লাইনের ধারে পাট পচানোর গন্ধ আর নিউ মার্কেটে শপিংরত বাঙালীর ঘামের গন্ধটাই বরাদ্দ থাকে। তবে মা আসছেন বলে পুজো কমিটির ব্যস্ততা,থিম পুজোর প্যাঁচ পয়জার আর রাতারাতি যেন ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান—এককালে বাঙালী ছিলাম রে। পাতার পর পাতা ঠাসা বিজ্ঞাপনের মাঝে গল্প,কবিতা,প্রবন্ধের গার্নিসিং করা পুজো বার্ষিকী তে পুজো পুজো আমেজটা আসে বৈকি। নতুন মোবাইল, অভূতপূর্ব ফোটো এডিটিং অ্যাপস সামলে খিচ্ মেরি ফোটো আর ফেসবুকে লাইকিত প্রোফাইল পিকচারে দেবী বন্দনার সুখ থেকে বঞ্চিত হতে নেই। ওরে বাবা বীরেন ভদ্র বাদ দেই কেমন করে?ভোর হওয়া মাত্র  নমঃ চন্ডী,সেতো সেই শারদীয়ারই এপিলগ। শেষপাতে আবার এক চুটকি সিন্দুর কি কিমত তুম ক্যায়া জানোগে, সিঁদুরে সিঁদুরে আর সিঁদুর খেলায় পুরো রঙ বরষে!

অষ্টমীতে লুচি- ছোলার ডালটা বাড়িতেই ভালো,আর তারপর লাইন দিয়ে রেস্টুরেন্টের টেবিলে মিউজিক্যাল চেয়ার খেলে,ডাব চিংড়ি,সরষে ইলিস, ঝিঙে পোস্ত, রসগোল্লা আর মিস্টি দইয়ের ঢেকুর তুলেই বাঙালীর শান্তি। সন্ধ্যেয় হল্লা বোল,চল প্যান্ডেলে। ফাঁক ফোঁকরে একটু গান হবে,দুগ্গা ঠাকুর মাইজি ব্লেসিং তোমার চাইজি। প্যাকেজে টুরিজমও আছে। 

ভেবে দেখুন,এত আয়োজন সব নিজেদের জন্য। তার জন্য তোমাকে চাই। প্ল্যানচেটে যেমন মিডিয়াম লাগে,তেমন ফূর্তির জন্য উপলক্ষ্য লাগে। লক্ষ্য —লক্ষ যোজন দূরে।

17Sep 2020
ONS Sd2175

Comments

Popular posts from this blog

আরুণির গুরুভক্তি

প্রাচীন ভারতে শিক্ষার্থীদের গুরুগৃহে গিয়ে থেকে শিক্ষা গ্রহনের একটা রীতি ছিল। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং নৈতিক মূল্যবোধের পাঠ পড়ানোর জন্য বৈদিক ঋষিরা আশ্রম প্রথার প্রচলন করেছিলেন। আশ্রমপ্রথা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি বর্ণাশ্রম, অন্যটি চতুরাশ্রম। কর্মের ভিত্তিতে সমাজে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র এই চার শ্রেনীর লোক বাস করত। মানুষের জীবনকালকে ভাগ করা হত ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্নাস এই চারটি শ্রেনীতে। ব্রহ্মচর্য পালনের সময় শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহে যেত। পুঁথিগত বিদ্যা ও নৈতিক মূল্যবোধের পাঠ শেষ করে  নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসে গার্হস্থ জীবনে প্রবেশ করত। শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহকে নিজের বাড়ির মতোই মনে করত। গুরুও শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিতেন। আজকের গল্পটা মহান ঋষি বেদব্যাস রচিত মহাভারত গ্রন্থ থেকে গৃহীত। আজকের গল্প আরুনির উপাখ্যান বা আরুনির উদ্দালক হয়ে ওঠার কাহিনী।  পুরাকালে ভারতে অয়োদ ধৌম্য নামে এক ঋষি ছিলেন। তাঁর আশ্রমে ব্রহ্মচর্য পালনের জন্য শিক্ষার্থীরা আসত। আরুণি, উপমণ্যু এবং বেদ নামে তাঁর তিন শিষ্য ছিল। তখন বর্ষাকাল। জলের তোড়...

দশানন রাবণকৃত শ্রী শিবতান্ডব স্তোত্রম

দশানন রাবণকৃত শ্রী শিবতান্ডব স্তোত্রম বাংলা অনুবাদ সহ (১) জটাটবীগলজ্জল প্রবাহ পাবিতস্থলে গলেহবলম্ব‍্য লম্বিতাং ভূজঙ্গতুঙ্গমালিকাম । ডমড্ডমড্ডমড্ডমন্নিনাদবড্ডমর্বয়ং চকার চন্ডতান্ডবং তনোতু নঃ শিবঃ শিবম।।।।। । (২) জটাকটাহ সম্ভ্রম ভ্রমন্নিলিম্পনির্ঝরী বিলোল বীচিবল্লরী বীরাজমানমূদ্ধনি।। ধগদ্ধগদ্ধগজ্জলল্ললাট পট্রপাবকে কিশোরচন্দ্রশেখরেরতিঃ প্রতিক্ষণং মম।। (৩) ধরাধরেন্দ্রনন্দিনীবিলাসবন্ধুবন্ধুর স্ফুরদ্দিগন্ত সন্ততি প্রমোদ মানমানসে কৃপাকটাক্ষ ধোরণীনিরুদ্ধদুর্ধরাপদি ক্বচিদ্দিগম্বরেমনো বিনোদমেতুবস্তুনি।।।। (৪) জটাভুজঙ্গ পিঙ্গল স্ফুরৎফণামণিপপ্রভা কদম্বকঙ্কুমদ্রবপ্রলিপ্তদিগ্বধূমুখে।। মদান্ধসিন্ধুরস্ফুরত্ত্বগুত্তরীয়মেদুরে মনো বিনোদ মদ্ভূতং বিভর্তু ভূতভর্তরি।। (৫) সহস্রলোচনপ্রভৃত‍্যশেষলেখশেখর প্রসূনধূলিধোরণীবিধূসরাঙঘ্রিপীঠভূঃ। ভুজঙ্গরাজমালয়া নিবদ্ধজাটজূটকঃ শ্রিয়ৈ চিবায় জায়তাং চকোর বন্ধুশেখর।।।। (৬) ললাটচত্বরজ্বলদ্ধনঞ্জয়স্ফুলিঙ্গভা নিপীতপঞ্চসায়কং নমন্নিলিম্পনায়কম। সুদাময়ূখলেখয়াবিরাজমানশেখরং মহাকপালি সম্পদে শিরো জটালমস্তু নঃ।।।।। (৭) করালভাল পট্টিকাধগদ্ধগদ্ধগজ্জল দ্ধনঞ্জয়াহুতীকৃতপ্রচন্ড পঞ্...

বিষ্ণুর দশাবতার

বিষ্ণুর দশ অবতার এর নাম হল --- মৎস্য কূর্ম বরাহ নৃসিংহ বামন পরশুরাম রাম কৃষ্ণ বুদ্ধ কল্কি 1. মৎস্য অবতার মৎস্য ভগবান বিষ্ণুর প্রথম অবতার রূপ। এই অবতার রূপে সত্যযুগে বিষ্ণুর আবির্ভাব। পুরাণ অনুযায়ী পৃথিবীর প্রথম মানুষ মনুকে এক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে মৎস্য রূপে বিষ্ণু আবির্ভূত হন। শরীরের উপরের অংশ পুরুষ মানুষের মত কিন্তু নীচের অংশ মাছের মত। 2. কূর্ম অবতার কূর্ম ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার। সত্যযুগে এই অবতার রূপে বিষ্ণু আবির্ভূত হন। পুরাণে বলা হয় সমুদ্রমন্থনের সময়, মন্থন কালে মন্দর পর্বত সমুদ্রের নীচে ডুকে যাচ্ছিল। তাই সেই সময় বিষ্ণু কূর্ম অবতার অর্থাৎ কচ্চপের রূপে আবির্ভূত হয়ে পর্বত তাঁর পৃষ্ঠে ধারণ করেন। যার ফলে অমৃত প্রাপ্তি সম্পূর্ণ হয়। 3. বরাহ অবতার বন্য শূকরের রূপ ধারণ করেছিলেন ভগবান বিষ্ণু। এটি তাঁর তৃতীয় অবতার। বরাহ অবতারে তিনি সত্য যুগে আবির্ভূত হন। পুরাণ মতে পৃথিবীকে হিরণ্যাক্ষ নামক মহাশক্তিশালী অসুরের হাত থেকে রক্ষা করতে এই অবতার রূপে বিষ্ণু আসেন। অসুর পৃথিবীকে মহাজাগতিক সমুদ্রের নীচে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বরাহ রুপী বিষ্ণু হিরণ্যাক্ষের সাথে ক্রমাগত হাজার বছর যুদ্ধ করে তাকে প...