পুরোনো কলকাতার বাড়িগুলিতে ভাঁড়ার ঘর একটি করে থাকতো l এখনকার ঝাঁ চকচকে মড্যুলার কিচেনের কাছে তার অবস্থান "গরীব ঘরের মেয়ের" মতন l তবু আমাদের ঠাক্মা, দিদ্মা মা, কাকিদের দিনের অনেকটা সময় কেটে যেত সেই একরত্তি একফালি ভাঁড়ার ঘরে, যা ছিল সব থেকে আপনার l ভাঁড়ার ঘরের যাপনে মিশে থাকতো কান্নাহাসির কত যে চুপকথারা, তা আজ তারই গপ্পো ...
ভাঁড়ার ঘর – ‘এ রুম অফ ওয়ান্স ওন’
ঠাম্মার ভাঁড়ার ঘরটা ছোটবেলায় আমার কাছে ছিল রবিনসন ক্রুসোর দ্বীপের মতোই l বাবার রাগঝাল আর মায়ের বকাঝকার থেকে নিরাপদ আশ্রয় l কোনো ঘর যে অত ছোট হতে পারে ধারণা ছিল না তবে ছোট বলেই হয়তো ওখানে নিজেকে নিজে খুঁজে পেতাম অত বড়ো করে l ঠাম্মা ছোটোখাটো মানুষটি, চুপ করে ওই ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে বসে থাকতো দিনের অনেকটা সময় l তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, মুক্তির আকাশখানা ছিল ওই ঘরেই l
যা হোক, ওই ভাঁড়ার ঘর তা বলে যেমন তেমন এলোঝেলো মার্কা ছিল না মোটেই l রকমারী গোল-চৌকো-বড়ো-ছোট কৌটো-কাওটা রাখা থাকতো, সার সার তাকে, যত্নভরে সাজানো গোছানো l সব একরকম, মেরুন রঙের l কী ভাবে ঠাম্মা বুঝতো কোনটাতে চাল ডাল আর কোনটাতেই বা বিস্কুট, জানি না l একটু উপরে একটা ঝুড়িতে ঝুলতো কলা, কখনোসখনো অন্য ফল l তখন আমাদের ছাদে দিনের বেলাতে অনেক পায়রা আসতো, আঁজলা ভরে ভরে ঠাম্মা ওদের ভাঁড়ার ঘরের জানলা দিয়ে গম দিতো বলেই l আমাকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখাতো ঠাম্মা l ওদের বকবকমে ভরে যেত ছাদ আর ভাঁড়ার ঘরটা l ঠাম্মা আমাকে বলতো, “বল তো ভাই, ওরা কি বলছে?” আমি না ভেবে সদ্য পড়া রূপকথার বইয়ের ভাষাতেই বলতাম, “ওরা বলছে, ঠাম্মা আর নাতনির জয় হোক l” ঠাম্মা হাসতো l জর্দা মাখানো ভুরভুরে সুবাসিত হাসি l মাথায় হাত রাখতো, আর বলতো, “এমন করে সবসময় ওদের দিও, কেমন?” তবে একটু রাত হলেই ভাঁড়ার ঘরের আবহাওয়া যেত পাল্টে l টিমটিমে এক বাতি জ্বলতো ওই ঘরে l ছাদের আর ভাঁড়ার ঘরের জানালা বন্ধ করে দিতো ঠাম্মা l তবু জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে উত্তুরে হাওয়া বইতো সিমসিমে l সিটি কলেজের দেয়াল বেয়ে মাঝে মাঝে ভাম এসে নামতো আমাদের ছাদেও l বেশ করে কান মাথা মুড়িসুড়ি, ঘোমটাপরা, স্নেহময়ী পিতামহী ওই জানলার খড়খড়ি দিয়ে আমাকে ভাম দেখাতো l ঝিম্ঝিমে অন্ধকারে ওদের চোখ জ্বলতো দিপদাপ করে l ভয়ে ঠাম্মার গায়ে মিশে থাকতাম আমি, ভয় পেতেও ভালো লাগতো আমার তখন l তারপর কখন আস্তে আস্তে ওদের গায়ের বনজ গন্ধ মিলিয়ে যেত l ঠাম্মা বলতো, “ওই ফিরে গেলো ওরা l আয় ভাই, শুতে যাবার আগে, আমরা 'ভবসাগরতারণ' গান গাই l” গলা মেলাতাম অমনি, আর দেয়াল থেকে ঠাম্মার গুরুদেবের ফটো হাসতো l ওই বিশাল দাড়ি গোঁফওয়ালা নবীন সন্ন্যাসী, গুরুদেব l দেহ রেখেছিলেন, আমার জন্মের কিছু পরেই l ছোটবেলা থেকেই মনে পড়ে আমার, ওঁর প্রতি বিশেষ মুগ্ধতা ছিল, অলৌকিক সব গল্প শুনে শুনে …
একটু বড়ো হয়েছি তখন l একদিন ভাঁড়ার ঘর থেকে একটা খুনখুনে কান্নার শব্দ পেলাম l গিয়ে দেখি ঠাম্মা কাঁদছে l আমি যেতেই আঁচল দিয়ে চোখ মুছে আমাকে আদর করলো রোজের মতো l জানি, দাদু বকেছে কোনো কারণে l সেই থেকেই জেনেছি, মেয়েদের লুকিয়ে কাঁদার জায়গাটির প্রয়োজন আছে l বড়ো হয়ে আরো ভালো বুঝেছি l কান্নার প্রয়োজন আছে মেয়েদের, সব ভুলেটুলে মনমেজাজ ঝেড়েঝুড়ে নিয়ে বৃষ্টিশেষে রোদ ঝলমলে দিনের মতন হয়ে ওঠার জন্যেই l আরও একটা কথা, আমি কখনো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদলে ঠাম্মা বলতো, “ছিঃ ভাই অমন করে কাঁদে না, শক্ত মেয়েরা সবার সামনে অনর্থক কান্নাকাটি করে নিজেকে অপমান করে না l”
ভাঁড়ার ঘরের স্নেহাবরণ, ঠিক মায়ের স্নেহের মতোই l ঠাম্মার একলা বড়ো ঘরটিতে ওকে কখনো কাঁদতে দেখিনি l দুঃখ হলে, কাঁদবার প্রয়োজন হলে ঠাম্মা ওই ছোট একখানি একটেরে ভাঁড়ার ঘরেতে আশ্রয় নিতো l ওহ হ্যাঁ, কথাপ্রসঙ্গে মনে এলো, ভার্জিনিয়া উল্ফ প্রতিটি মেয়ের, এমন একটি ছোট ঘরের কথা লিখে গেছেন l কিছু অর্থ আর নিজের একখানি ঘর, লেখালেখির জন্যে যা বিশেষ প্রয়োজন l সার কথা l আমারও আছে, ওই ভাঁড়ার ঘরের চেয়ে কিঞ্চিৎ বড়ো একটা পড়ার ঘর l তাতে ভাঁড়ার বলতে যত রাজ্যের বইপত্র l আমার মনের ভাঁড়ার l সারাজীবনের ভালো থাকার রসদ l আর নিভৃতে নিজের সাথে আলাপনের ঘরখানি l
আজ প্রায় এতো বছর বাদে ভাবি, সব মেয়ের একা হওয়ার প্রয়োজনের কথা মাঝেমাঝেই l একটুখানি অবকাশ, যেখানে নিজেকে নিজে মেলে দেওয়া যায় l নিজের সাথে নিজে কথা বলে, বোঝাপড়ার শেষে, আবার পৃথিবীর ঝড়ঝাপ্টার সম্মুখীন হবার জন্য তৈরী হয়ে নেওয়া যায় l চোট খাওয়া শিরদাঁড়াটা বেশ মেরামত করে শক্তপোক্ত, ঋজু করে নেওয়া যায় l ঠাম্মাও ওই ছোট ঘরটিতে বসে বাবার দেওয়া একটা ডায়রিতে কিছুমিছু লিখতো আর আমরা গেলেই সেই ডায়রি চালান করে দিতো চালের না ডালের কৌটোতে l আজ হঠাৎ মনে এলো, আমার বাবা চলে যাবার সেই রাতটাতেও কি ঠাম্মা সারারাত ভাঁড়ার ঘরে বসেছিল? আছড়েপিছড়ে কেঁদেছিলো, বড়ো ছেলের কথা মনে করে করে? আর সারাজন্মের ওই ভাঁড়ার ঘর মরমী সইয়ের মতো আপ্রাণ জড়িয়ে ধরে থেকেছিল, ঠাম্মাকে দুই হাতের ফেরে ?
বাবা চলে যাবার কিছু দিনের মধ্যে ঠাম্মা চলে যায় l অনেক খুঁজেও আমি সেই লেখার খাতাটি খুঁজে পাইনি কোত্থাও l পরে, অনেক পরে ঠাম্মার ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে দেখি, শিশিরের মতো অশ্রু আর মনখারাপের মেঘ জমে আছে ঘরের ইতিউতি l আর আমি সেই সব মেঘেদের টুপটুপ কুড়িয়ে মনে ভরে ভরে রেখেছি, অবকাশে বৃষ্টি লিখবো বলে l
- অপর্ণা গাঙ্গুলী
(ছবি - আন্তর্জাল)
Comments
Post a Comment